- সৈয়দ তানবীর মাহমুদ খোন্দকার
১৯৯৬ সাল। আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। আমার আব্বা ফরিদ আহমদ খোন্দকার বিএবিএড, প্রধান শিক্ষক ( জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত )। পালং হাইস্কুলের শৃঙ্খলা ছিল দেশসেরা। এখন সেই নিয়ম শৃংখলা কোন স্কুলে আছে বলে মনে হয়না। হয়তো মিলিটারি স্কুলে থাকতে পারে। আর শিক্ষকরা ছিলেন সত্যিকারের নির্ভেজাল শিক্ষক। এই শিক্ষক পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। জ্ঞানে গুণে, ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যে তারা ছিলেন অনন্য। তারা ন্যায় বিচারক ছিলেন। সেই শিক্ষক আমার হৃদয়ে থাকবেন আজীবন।
আজকাল এই ধরনের শিক্ষক নেই বললে চলে। এই শিক্ষক রা সত্যিকার অর্থে শিক্ষকতাকে নেশা হিসেবে নিয়েছিলেন। তারা প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মত শিক্ষা দিয়েছেন। সেই সাথেই শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, নম্রতা, মূল্যবোধ ও মানবতার শিক্ষা ও দিয়েছেন। অবশ্যই সবকিছু নির্ভর করে প্রতিষ্টান প্রধান এর উপর।
আমার আব্বা ছিলেন খুবই স্টেইট ফরোয়ার্ড ও কড়া শাসনের অধিকারী। যিনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেন। শিক্ষক হিসেবে আমার আব্বা হলেন জাত শিক্ষক। তিনি কখনো নয় ছয় করেন নি। আমি হলফ করে বলতে পারি আমার বাবা হলেন সর্বকালের শিক্ষকদের একজন। হয়তো কেউ কেউ অন্যভাবে নিতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। কে কি বলল তা নিয়ে মোটেও ভাবিনা। চলার পথে বাধা আসবে। সেই বাধা অতিক্রম করে চলতে হবে।
কেন তাই বললাম। সেই প্রসঙ্গে বলছি- আমি আর আমার বন্ধু আবু তাহের ( বসু মেম্বার এর ছেলে ) গণিত ঘন্টা শেষ হওয়ার পর দুজন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। সবেমাত্র গণিত শিক্ষক চলে গেলেন। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার আব্বা ফরিদ আহমদ খোন্দকার ( প্রধান শিক্ষক ) উনার অফিস হতে বের হয়ে বারান্দায় হাঁটছিলেন। একটু সামনের দিকে এসে আমাদের দুজন কে দেখে ফেললেন। আমরা দুজন দৌড়ে আমাদের জায়গাই গিয়ে বসি। ক্লাসে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন কে কে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল? তখন আমি আর আবু তাহের দাঁড়ালাম। আব্বা ( প্রধান শিক্ষক ) বললেন তুমি ( আমি তানবীর) বেঞ্চের উপর ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাক। আর আবু তাহের কে বলল, তুমি বস, তোমাকে দাঁড়াতে হবে না। অপরাধ দুজনের ছিল। কিন্তু প্রধান শিক্ষক আমাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। অথচ অন্য কেউ হলে নিজের ছেলেকে শাস্তি না দিয়ে অন্যকে শাস্তি দিতেন। আজকাল কি শিক্ষক রা এটা মানেন? সেই শিক্ষক আদৌ আছে? যাহোক সেদিন আমার ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী বলেছিলেন প্রধান শিক্ষক হলে স্যারের মত হতে হবে। স্যার নিজের ছেলেকে শাস্তি দিতে কার্পণ্য করেন নি। আমার বন্ধুদের অনেকেই সেদিন বলেছিল স্যার যে একজন ন্যায় বিচারক আজকে প্রমাণ করে দেখালেন।
১৯৯৭ সাল। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। প্রশান্ত স্যার আমাদের কৃষি বিজ্ঞান পড়াতেন। স্যার আমাদের বাসায় থাকতেন। আমাদের গণিত পড়াতেন। ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিলেন আবদুল্লাহ আর আমি ছিলাম সেকেন্ড বয়। আমানত ছিলেন তৃতীয়। আমাদের মধ্যে খুবই কম্পিটিশন ছিল। উল্লেখ্য আমানত আর আবদুল্লাহ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আর আমি ছিলাম মানবিক বিভাগের ছাত্র । এসএসসি প্যাকটিক্যাল পরীক্ষার খাতা প্রশান্ত স্যার নিজেই মূল্যায়ন করেন। আমি যা লিখেছি আবদুল্লাহ ও তাই লিখেছে। তাহলে দুজন সমান মার্ক পাওয়ার কথা। আব্বা ( প্রধান শিক্ষক ) প্রশান্ত স্যারকে বলিষ্ট কণ্ঠে বলেন, প্রশান্ত বাবু আপনি নিজেই খাতা মূল্যায়ন করছেন। তানবীর যদি আবদুল্লাহর চেয়ে ও ভালো লিখে তারপরও তাকে হাইমার্ক দেবেন না। এমনি একই নাম্বার ও দেবেন না। আব্বা আবারো বললেন, আমার ছেলেকে হাইমার্ক দেবেন না। আপনি আবদুল্লাহ কে সর্বোচ্চ মার্ক দেবেন। কেননা আপনি আমার বাসায় থাকেন। দ্বিতীয়ত লোকে যেন বলতে না পারে হেডমাষ্টারের ছেলে তো, এজন্য সর্বোচ্চ মার্ক দিয়েছে। সাক্ষী কারো দরকার নেই। সাক্ষী পরম করুণাময় আল্লাহ। আমরা কি এই নীতি মেনে চলি?
আসুন আমরা সব প্রতিকূলতার মাঝে যেন ন্যায়বিচার করি। কারো প্রতি অবিচার যেন না হয়।
#সৈয়দ তানবীর মাহমুদ খোন্দকার ,সহকারি শিক্ষক ,মধ্য রাজাপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মোবাইল – ০১৯২১৭৪৮১০৪.
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।